পরিবেশ দূষণঃ আজও যা এক ধোঁয়াশা


রূপা ব্যানার্জীঃ আবার একটা পরিবেশ দিবস। আবার কিছু সাজানো গোছানো কথা। পড়বো এবং যথারীতি বন্ধ করে রেখে দেবো। কিছুক্ষনের জন্য যদিও বা স্বার্থবিরোধী চেতনা জেগে ওঠে কিন্তু আবার সেই স্বার্থপরতার পোকা কাটতে শুরু করে দেয়। এই হলাম আমরা, এক অদ্ভুত প্রজাতি। আপাতদৃষ্টিতে নিজেদের ভাল করছি মনে করে গোটা দুনিয়ার অন্যান্য সমস্ত প্রজাতির খারাপ করে বসি, অবশ্য মুলগতভাবে নিজেদেরও খারাপ করি।

পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা আজকের নয়। কোন ছোটবেলাতেই আমরা জগদীশচন্দ্র বসুর আবিষ্কারের কথা পড়ে অবাক হয়েছি। মনে পড়ে, সেই ছোটবেলাতে যখন গাছের একটা পাতা ছিঁড়তাম মা বকতো আর বলতো, ‘বইতে পড়ো নি, গাছেরও প্রান আছে। তাদেরও লাগে, ভেতরে ভেতরে তারাও কাঁদে’। তখন বেশ মজাই লাগতো, গাছ নাকি আবার কাঁদে! আবার একটু বড়ো হতেই গাছ নিয়ে রচনা, ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’ বা ‘বৃক্ষরোপণ’। তখনও এসব বলার কারন বা তার ভেতরের গূঢ় তত্ত্ব বোঝার বোধ আমার হয় নি। আর এখানেই তো আয়রনি। বোধের জায়গাটা আমাদের তখনই নাড়া খায় যখন আমাদের কাজগুলো ব্যুমেরাং হয়ে আমাদের দিকেই ফিরে আসে। এখনও মনে হয়, একটি গাছ একটি প্রান কথাটা আজও ভীষণভাবেই ভুল। কারন, একটি গাছ কয়েকশো প্রানের সমান।

এ নিয়েই বেনারস অধিবেশনে ১৯৮১ সালে প্রকৃতি বিজ্ঞানী তারকমোহন দাস পরিবেশে উদ্ভিদের অবদান নিয়ে একটি বক্তৃতা করেছিলেন। তার সংক্ষিপ্তসার এটাই ছিল,
(১) ৫০ বছরে একটা গাছ অন্তত পঁচিশ লক্ষ টাকা মূল্যের অক্সিজেন দেয়।
(২) একজন মানুষের দিনে গড়ে তিন কেজি শুদ্ধ অক্সিজেন প্রয়োজন। উল্টোদিকে সে ত্যাগ করে সাড়ে বারো কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড, যার গ্রহিতাও সেই গাছ।
(৩) একটা শিরিষ গাছ বছরে সাড়ে আঠাশ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে।
(৪) তাছাড়া একটা গাছের পাখি, পোকামাকড়, লতাপাতাকে আশ্রয় দানের মূল্য আড়াই লক্ষ টাকা। মানুষের জন্য খাবার জোগায় কুড়ি হাজার টাকা মূল্যের। এরপর সে যদি আবার ফুল ও ফলের গাছ হয় তাহলে সে মূল্য তো অপরিমেয়। আর্থিক ছাড়াও নান্দনিকতার মূল্য, মাটির ক্ষয়রোগ, উর্বরতা বৃদ্ধি, অমূল্য সেবার ন্যূনতম মূল্য আড়াই লক্ষ টাকা। বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে বৃষ্টিপাতের মূল্য তিন লক্ষ টাকা। বায়ুদূষণ ঠেকিয়ে সাশ্রয় করায় পাঁচ লক্ষ টাকার। এটুকু উদাহরণই বুঝিয়ে দেয় আমরা জঙ্গলের পর জঙ্গল উড়িয়ে যে কংক্রিটের জঙ্গল বানাবার চেষ্টা করছি সেটা কতটা বালখিল্যতার পরিচয়। আসলে পরিবেশ দূষণের চাইতেও যেটা বড়ো হয়ে দাঁড়ায় তা হল রাষ্ট্র, সমাজ বিশেষত মানুষের চেতনা আজ দূষণে পরিপূর্ণ।

৫জুন পরিবেশ দিবস। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যাবে ভারী ভারী কথা, তার থেকেও কতশত ক্রিয়েটিভ বিজ্ঞাপনে। আমরা দেখবো সেগুলোকে শেয়ার করবো। না জানি আমরা কতটা উদ্বিগ্ন। গ্রীনহাউস গ্যাস, সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি, উষ্ণায়নের দরুন বরফ গলে গিয়ে জলস্তর উঠে আসা এবং একটা সময় জলের নীচে সুনামীর ফলে পৃথিবী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এরকম কত জ্ঞানের কথা শুনবো। রেজোলিউশন নেবো। আবার ৬জুন সূর্যোদয় হতে না হতেই সব রেজোলিউশন ভুলে পুরানো নিয়মে ফিরে যাবো। আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, এভারেস্টে মানুষের ফেলে আসা আবর্জনার কথা। শোনা যায়, সমুদ্রে তিমি মাছ মারা যাওয়ার কথা। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে জানা যায় তাদের পেট থেকে প্রচুর পরিমানে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। আর মৃত্যুর কারন সেটাই। আমরা সব জানি। কিন্তু এতটাই আত্মকেন্দ্রিক জাতি আমরা যে, সামান্য প্লাস্টিক বর্জন করতেও আমাদের কত কষ্ট। আসল সত্য হল, আমরা মানবজাতি যখনই কোন নতুন জায়গা খুঁজে পাই তখনই বাকী জীবেরা অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে। বাহ্যিকভাবে যতই চাকচিক্য করি না কেন ভেতর সেই অন্তঃসারশূন্যই থেকে যায়।

আচ্ছা, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমরা এই পৃথিবীতে ভাল কি রেখে যাচ্ছি? খোদার ওপর খোদকারী করতে গিয়ে বুঝতে পারি না আমরা কত নৃশংস হয়ে যাচ্ছি। আর যার ফলে প্রত্যেকটা দিন একটু একটু করে আমরা এক জীর্ণময় সভ্যতায় ঢুকে পড়ছি। আর জীর্ণ হতে হতে কালের নিয়মে হয় এই সভ্যতা নিশ্চিহ্ন, ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে নাহয় জলের তলায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। সেদিন যদি আমাদের বিবেক জাগ্রত হয় তবে একটাই প্রশ্ন আমাদের কুড়ে কুড়ে খাবে, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো- হে সভ্যতা হে মানবতা, এই দীর্ণ মানুষগুলোকে ক্ষমা করতে পারবে কি কোনদিনও??”


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।

2 × 5 =