“উদং কালীমাতা আশ্রমের ইতিহাস”


পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : হাওড়া জেলার মানচিত্রে অন্যতম উদং গ্রাম। এই জেলারই আমতা থানার অন্তর্গত উদং গ্রামে দামোদরের তীরে প্রায় শতাধিক বছরের পুরানো একটি কালীমাতা মন্দিরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি আশ্রম। যা আজ কেবল হাওড়া জেলা নয় বাংলার মানচিত্রে পর্যটন কেন্দ্র ও পবিত্র ভূমি হিসাবে স্থান করে নিয়েছে।

চলুন, আজ আমরা এই সুপরিচিত আশ্রমের অতীতের দিনগুলিতে পাড়ি দিই।

যতদূর জানা যায়,’বাংলার দুঃখ’ দামোদর নদ ছিল এই অঞ্চলের মানুষের ত্রাস। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে দামোদরের ভয়াবহ বন্যা ঐ অঞ্চলের মানুষজনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করত। বন্যার কবলে পড়ে শুরু হয় মহামারি। উদং গ্রাম কার্যত শ্মশানভূমির রূপ পরিগ্রহ করে। এর ফলে গ্রামের মানুষজন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ঈশ্বরের দ্বারস্থ হন। গ্রামের বিভিন্ন মন্দিরে শুরু হয় পূজার্চনা। এই প্রেক্ষাপটেই উৎসারিত হয় উদং কালীমাতা আশ্রম ও মাতৃমন্দির।

উদং-ফতেপুরের প্রবীণ মানুষজনদের থেকে জানতে পারা যায়, স্বর্গীয় পঞ্চানন বেরা, স্বর্গীয় সাধন বাগ, স্বর্গীয় শ্যামাপদ পট্টনায়ক, স্বর্গীয় চাঁদু পাত্র, স্বর্গীয় ভজহরি ঘোষাল, স্বর্গীয় রাম বেরা প্রমুখের আন্তরিক প্রয়াসে বাঁশের দরমাযুক্ত টিনের ছাউনি বিশিষ্ট ঘরে কালীমায়ের তৎকালীন মৃন্ময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর ১৩৪৯ সালে বাংলার বুকে নেমে আসে প্রলয়ংকারী ঝড়। সেই প্রবল ঝড়ে মায়ের মূর্তিসহ মন্দির নষ্ট হয়ে যায়। এরপরই শোনা যায় এক অলৌকিক ঘটনা। উদং পোদ্দার পাড়ায় স্বর্গীয় দেবেন দত্তের জামাই নবকুমার আঢ্য হুগলী জেলার নন্দপুরের বাসিন্দা, স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি আসেন। রাতে যখন তিনি গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন তখন তিনি স্বপ্নে দেখেন,”নব আমার মন্দির ভেঙে গেছে, আমার মন্দির গড়ে আমার চিন্ময়ী মূর্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা কর, তোর মঙ্গল হবে।”পরের দিন ধনীবংশের প্রতিনিধি নবকুমার বাবু ভগ্ন মন্দির দেখতে আসেন। গ্রামবাসীগণের সাথে আলোচনা করে নবকুমার বাবু থলিয়া গ্রামের “মদন ও নীলকন্ঠ”কে মাতৃমূর্তি তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই সময় ফতেপুর গ্রামের স্বর্গীয় নদেরচাঁদ সাহা ও স্বর্গীয় ভজহরি ঘোষাল মন্দির নির্মানের জন্য ভূমিদান করেছিলেন।

এইভাবে কেটে যায় বেশ কয়েক দশক। চারিদিকে জঙ্গল, মায়ের মন্দিরে জল পড়ে, সন্ধ্যার পর ভয়ে কেউ আর আসতো না। সালটা ছিল সম্ভবত ১৩৯০ বঙ্গাব্দ।কিছু ধর্মপ্রাণ সহৃদয় ব্যক্তির আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও আর্থিক সহায়তায় পুনরায় নতুন করে পথ চলা শুরু হল। শুরু হল নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিবরাত্রি, অন্নকূট, জন্মাষ্টমী, পৌষ সংক্রান্তি প্রভৃতি। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে দামোদরে স্নানের ঘাট নির্মাণ করা হয়। এভাবেই অতিবাহিত হল বেশ কিছু বছর। ১৪১১ সালের অন্তিম লগ্নে গ্রামের কিছু মানুষের নিরলস প্রচেষ্টায় নতুনভাবে গড়ে উঠল মাতৃমন্দির ও পাথরের মাতৃমূর্তি। তার সাথে গড়ে উঠল শিবমন্দির, শনি মন্দির, রাধাকৃষ্ণ মন্দির। আশ্রমের পরিবেশকে চিত্রাকর্ষক করে তুলতে গড়ে উঠল সুসজ্জিত ফুলের বাগান, পাখিরালয়, পার্ক। বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে জলপ্রকল্প। এভাবেই ‘উদং কালীমাতা আশ্রম’ স্থান করে নেয় পশ্চিমবঙ্গ তথা হাওড়া জেলার পর্যটন মানচিত্রে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু দর্শনার্থীর আগমনে কলকাকলিমুখরিত হয়ে ওঠে এই সুশান্ত পরিবেশ ও সুসজ্জিত আশ্রম।।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।

nineteen + ten =