আমতার ঐতিহ্য-সংস্কৃতিতে বিবেক যোগ


পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : হাওড়া জেলার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বন্দরনগরী ‘আমতা’। আমতার প্রতিটি বিন্দুতে জড়িয়ে আছে কত স্মৃতি,কত শত অজানা গল্প। তেমনই এক কাহিনী ‘স্বামীজির ও আমতা’। একাধিক ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে ইতিহাসের বহু সাক্ষ্যবহনকারী আমতার যোগসাজশ পাওয়া গেছে। সেই সকল তথ্যকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজ লিখনশৈলীর মাধ্যমে তিলোত্তমা রূপ দানের ক্ষুদ্র চেষ্টা করলাম। স্বামী বিবেকানন্দেরা (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন অনেক ভাইবোন। তারই মধ্যে স্বামীজির জ্যেষ্ঠা ভগিনীর নাম ছিল ‘হারামণি’। জন্ম ১৮৫৮ সালে।

সম্ভবত দুই সন্তানের অকাল মৃত্যুজনিত কারণেই এই নাম রেখেছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত। শৈশবে তিনি ‘বেথুন কলেজিয়েট স্কুল’র ছাত্রী ছিলেন। এমনকি সূচীশিল্পেও ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তৎকালীন প্রচলিত রীতি বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পাননি স্বামীজির ভগিনী ‘হারামণি’। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই পিতা সুপাত্রের খোঁজ শুরু করেন। এইভাবেই তিনি খুঁজে পান আমতার কাছে খড়িয়পের জমিদার সূর্যকুমার বসুর সুপুত্র মাখনগোপাল বসুর। মাখনগোপাল সুপুরুষ, সুদর্শন, সুউপায়ী ও কলকাতার এক সওদাগরি অফিসে কর্মরত। দুই পরিবারের সহমতে ১৮৬৮ সালে মাখনগোপাল ও হারামণির বিবাহ হয়। মাত্র দশ বছর বয়সে বিশ্ববরেণ্য বীর সন্ন্যাসীর ভগিনী আমতার নিকট খড়িয়প গ্রামের জমিদার বসু পরিবারের বধূ হয়ে এলেন। হারামণি দেবীর জীবন খুব সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে কাটছিল। ১৭ বছর বয়সে তিনি জন্ম দিলেন এক কন্যা সন্তানের। নাম রাখলেন ‘শিবকালী’। প্রথম কন্যাসন্তান হওয়ায় তিনি বসু পরিবারের অপ্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলেন ক্রমশ। তাদের দাম্পত্যজীবনে ক্রমশ দুঃখের আধার ঘনিয়ে এলো। মাখনগোপাল ক্রমশ মুখ ফেরাতে থাকলেন তার প্রিয়ার দিক থেকে। অন্যদিকে, মাখনগোপাল কর্মসূত্রে প্রায়শই কলকাতায় শিমলার শ্বশুরবাড়িতে যেতেন। বিশ্বনাথের জ্ঞাতিভাই তারকনাথ দত্তের তৃতীয় কন্যা হরসুন্দরীর রূপে, গুণে তিনি মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি হরসুন্দরীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে তারা প্রথমে রাজি না হলেও তারকনাথ বাবু ও ওনার স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরী দেবী কোনোভাবেই অখুশি ছিলেন না। এই খবর যখন হারামণি দেবী পেলেন তখন তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানান।তাদের মধ্যে প্রবল মোনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। এরই কয়েকদিন পর ১৮৮০ সালে একদিন সন্ধ্যায় তিনি কলকে নামক বিষাক্ত ফল খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তবে আরেকটি সূত্র অনুসারে জানা যাচ্ছে যে, হারামণি দেবীকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল ও তার দেহকে বসুপরিবারের নাচঘরের বাগানের কোনো স্থানে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হারামণি দেবীর মৃত্যসংবাদ পেয়ে দু’দিন পর আমতার মাটিতে পা রাখলেন বিশ্ব ভাতৃত্বের মূর্ত প্রতীক মহামানব চিরপ্রণম্য বিশ্ববরেণ্য ভুবনজয়ী সন্ন্যাসী ‘স্বামী বিবেকানন্দ’।সালটা ছিল ১৮৮০। তিনি ভাগ্নি তথা ৫ বছরের শিবকালীকে নিয়ে কোলকাতায় ফেরেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, স্বামীজি জীবনে খুব কমই দুঃখ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে হারামণি দেবীর মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত দুঃখ পান।

পরবর্তীকালে সরকারি হস্তক্ষেপে জমিদারী প্রথা লোপ পেলে বসু পরিবার এই বেড় বাগানবাড়ি, নাচঘর, ‘রামকৃষ্ণ মিশন’-কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ না করায় এখানে ১৯৯৫ সালে গড়ে ওঠে ‘শ্রী রামকৃষ্ণ প্রেমবিহার আশ্রম’। বর্তমানে সেখানে বিদ্যালয়-পাঠাগার-মন্দির গড়ে উঠেছে। স্বামীজির পদার্পণধন্য এই স্থান যে কত পবিত্র তা হারামণি দেবীর মৃত্যুর শতবর্ষ পরে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমবিহার স্থাপন’-এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়।
আবার অন্যদিকে, ভারত বিখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত ও সমাজসংস্কারক আমতার ভূমিপুত্র মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের পুত্র মন্মথ ভট্টাচার্য ছিলেন স্বামীজির কলেজবন্ধু। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর ১৮৯৪ সালে স্বামী বিবেকানন্দ মাদ্রাজ পাড়ি দেন। এই সময়ে তিনি তাঁর মাদ্রাজে নিযুক্ত বন্ধু প্রথম ভারতীয় ‘Accountant General Of Madras’ মন্মথ ভট্টাচার্যের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।

আবার, আরো একটি ক্ষেত্রে আমতার সাথে এই ভুবনজয়ী ব্যক্তিত্বের পরোক্ষ সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। স্বামীজি নারীশক্তিকে তথা চিন্ময়ী সত্ত্বাকে দেবীরূপে পূজা করার উদ্দেশ্যে বেলুড় মঠে ১৯০২ সালে দুর্গাপূজার মহাষ্টমী তিথিতে ‘কুমারী পূজা’র সূচনা করেন। প্রথম কুমারী পূজায় কুমারী হয়েছিলেন আমতার ভূমিপুত্র তথা স্বামীজির সুহৃদ মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যা(যদিও আমি নাম খুঁজে পেতে অসমর্থ)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেলুড় মঠের কুমারী পূজা দেখতে শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরে থেকেও লক্ষাধিক মানুষ ভিড় জমান পুণ্যভূমি বেলুড়ে। তাই আমতাবাসীর কাছে এটাও অত্যন্ত গর্বের বিষয়। বিশ্ববরেণ্য বীর সন্ন্যাসী তথা ভারত আত্মার মূর্ত প্রতীক স্বামী বিবেকানন্দের পাদস্পর্শে ধন্য আমতা তথা তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তাই
আমতার প্রতিটা কণায় লুকিয়ে আছে কত ভালোবাসার ঝরণাধারা। সেই ভালোবাসার গল্প কখনোই শেষ হয়না। আমতার বুকে তৈরী হয়েছিল হাজারো নিত্যনতুন গল্প। আমতার ইতিহাস -ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিজড়িত সেই সমস্ত গল্প হার মানায় সহস্র আরব্য রজনীকেও। আমতার কোনো অতীত নেই। সে নিজেই নিজের চিরপ্রবাহিত গল্পকথা।

“ইতিহাস নয়, এখানেই শেষ হলো স্বামীজির আমতা যোগের এই কাহিনী।”

★তথ্যসূত্রঃ————-

১.নিবোধতপত্রিকা,
২.মাননীয় প্রদীপ রঞ্জন রীত
৩.Wikipedia


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।

twenty + six =